আনোয়ারায় একটি সার কারখানার গ্যাস ট্যাংকে ছিদ্র হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় অ্যামোনিয়া গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে। এতে অসুস্থ হয়ে পড়ে কমপক্ষে ২০০ জন। তাদের মধ্যে ৩৭ জনকে চমেক হাসপাতালে আনা হয়েছে। রাত দেড়টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত গ্যাস ট্যাংকের ত্রুটি সারানো যায়নি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আগ্রাবাদ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানা গেছে, পটিয়া লামারবাজার নন্দনকানন স্টেশন থেকে চারটি গাড়ি পাঠানো হয়েছে এলাকায়। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
আনোয়ারার রাঙ্গাদিয়ায় অবস্থিত বিসিআইসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সার কারখানায় গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে গ্যাস ট্যাংক লিক হয়ে অ্যামোনিয়া গ্যাস বের হয়ে আসতে শুরু করে। এ গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে সংলগ্ন তিন/চার কিলোমিটার এলাকায়। এক পর্যায়ে নগরীর পতেঙ্গা, হালিশহর এবং আগ্রাবাদ এলাকায়ও গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার খবর আসতে থাকে। এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। আনোয়ারায় কারখানা সংলগ্ন এলাকার অনেককে আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে দেখা যায়। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কারখানা কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ এ ব্যাপারে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
সিইউএফএলের সন্নিকটেই ডিএপি কারখানাটি অবস্থিত। স্থানীয়রা জানান, ডিএপি–১ সার কারখানার প্রধান গেইটের পাশে ৫০০ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যামোনিয়াম স্টোরেজ ট্যাংকে লিকেজের ঘটনা ঘটে। কারখানায় কাছাকাছি তিনটি ট্যাংকের একটিতে ছিদ্র হলেও বাকি দুটি ঠিক আছে বলে জানা গেছে। তবে কিভাবে এ ট্যাংকে ছিদ্র হয়েছে তা কেউ জানাতে পারেনি। অ্যামোনিয়া ট্যাংক এলাকার নিরাপত্তা রক্ষীরা রাত সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ করে ঝাঁঝালো গ্যাসে আক্রান্ত হন। এসময় অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তাৎক্ষণিকভাবে কাফকোর কর্মী ও এলাকার লোকজন অসুস্থ নিরাপত্তা রক্ষীদের উদ্ধার করে কাফকো কলোনির চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে আসেন। ঘটনার পর পরই কাফকো ও সিইউএফএলের বিশেষ টিম উদ্ধার অভিযানে নামে। পরে পটিয়া থেকে ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম এসে উদ্ধার কাজে যোগ দেয়। অসুস্থদের মধ্যে প্রায় ১২০ জন আনসার সদস্য ও বাকীরা পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা বলে জানা গেছে।
অসুস্থদের চিকিৎসার জন্য কাফকো মেডিকেল সেন্টার উন্মুক্ত করে দেয় কাফকো কর্তৃপক্ষ। কাফকো মেডিকেল সেন্টারের কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, ১১টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত তিনি অন্তত ২০০ লোককে চিকিৎসা দিয়েছেন। রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত গুরুতর অসুস্থ ৩৭ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদেও ১৩ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
ডিএপি সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমল বড়ুয়া ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ডিএপি–১ এ গ্যাস লিক হয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি।
কাফকো মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা নেওয়া কয়েকজন হলেন, মোহাম্মদ জয়নাল (৩৫), জনি (৩৮), শাহজাহান (৪০), রায়হান (৫০), মোস্তাফিজ (২৪), এনামুল (৩৫), হুমায়ুন (৫০), নুরুন্নবী (৩৫), বাবলু (২৯), আবদুর রব (৫০), জাহাঙ্গীর (২৪), কামাল (২৬), কুদ্দুছ আলী (৪০), মোছলেম উদ্দিন (২৫), সুজা মিয়া (৩৫), রবিন (২৪), সেলিম (২৬), সুমন (২২), রওশন আলী (৪৫), খোরশেদ আলম (৫০), এহসান আলী (২৪), নুরুল আমিন (৫০), সাজ্জাদ হোসেন (৪০), জাহের (৪০), দিদারুল (৩০০, নাসির (৩৫), আবদুর রহমান (৩০), জসিম উদ্দিন (২৪), আনোয়ার (৩৮), জামাল (২৭), সাইফুল (২৮), সোহেল (২৭) ।
এদিকে বৈরাগ, বন্দর, রাঙ্গাদিয়া, গোবাদিয়াসহ আশপাশের গ্রামের মসজিদ থেকে লোকজনকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়। স্থানীয় বৈরাগ এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জানান, অ্যামোনিয়া লিকেজের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কাফকো কলোনিসহ আশপাশের শত শত লোক বিষক্রিয়া এড়াতে ঘরবাড়ি ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরসহ নিরাপদে সরে যাচ্ছেন।
জানা যায়, বাতাসের অনুকূল গতিপথে গ্যাসের গন্ধ ছড়াচ্ছে বেশি। এতে বন্দর, পতেঙ্গা, ইপিজেড এলাকায় কিছু লোক শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে চিকিৎসকদের মতে গুজবের কারণে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বেশি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও কারখানার নিরাপত্তা কর্মী আনসার মাইরুদ্দিন কামাল বলেন, আমি ডিউটি শেষ করে বের হচ্ছিলাম। বাইরের গেটের কাছে আসতেই বিকট একটা শব্দ পায়। এটা একটা অ্যামোনিয়া গ্যাস ট্রাংক ছিল। এই সময় সেখানে কিছু কর্মকর্তা ও আনসার সদস্য কর্মরত ছিলেন। তাদের প্রায় সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমার নিজেরও মাথা ব্যাথা শুরু করে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এর জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, অসুস্থদের মধ্যে সামছুল নামে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অসুস্থদের মধ্যে মূলত আতঙ্ক কাজ করছে। এছাড়া তাদের চোখ ও বুক জ্বালাপোড়া করছে। মাথা ব্যথা করছে। বাকিদের অবস্থা আশঙ্কা মুক্ত।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এর বায়োক্যামেস্ট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাতাসে অ্যামোনিয়া ছড়ালে এর প্রভাবে মাথায় ঝিমুনি, বমি ভাব ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। নিশ্বাসের সাথে এই গ্যাস শরীরে প্রবেশ করার সাথে সাথে শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। গ্যাসটি রক্তে বিষক্রিয়া তৈরি করতে পারে। যার প্রভাবে ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। তার শরীরে খিচুনি হতে পারে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য এটা বেশি ক্ষতিকর। স্থায়ী ক্ষতি হল কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’
লামার বাজার ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলম রাত ১টা ৪০ মিনিটে জানান, গ্যাস নির্গমন এখনও বন্ধ হয়নি। এখানে অনেকগুলো চেম্বার আছে। মেইন লাইনটি বন্ধ করা যাচ্ছে না। মূলত গ্যাস এর কারণে আমরা মেইন লাইনের কাছে যেতে পারছি না।
তিনি বলেন, আমরা যেখান থেকে গ্যাস নির্গমন হচ্ছে সেখানে পানি ছিটিয়েছি। আশেপাশে পানির কোনো সোর্স নেই। যার কারণে পানি ভালোভাবে ছিটানো যাচ্ছে না। এছাড়া যারা পানি ছিটাচ্ছে তারা মূলত মাক্স পরে যাচ্ছে।
গ্যাস লিকেজে পানি ছিটানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অ্যামোনিয়া একটি ভারী গ্যাস। পানি ছিটালে এটা বাতাসে কম মিশবে।
এদিকে এই ঘটনায় জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মমিনুল ইসলাম, কর্ণফুলী থানার ওসি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
গ্যাসে আক্রান্তদের জন্য ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে : ১. মুখ ভিজা গামছা দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে , সম্ভব হলে চোখও। ২. যে কোনো ধরনের অগ্নিসংযোগ (সিগারেট, কয়েল, গ্যাসের চুলা) করা থেকে বিরত থাকা একান্ত জরুরি । ৩. ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ রাখতে হবে, এমনকি বন্ধ করে দিতে হবে ভেন্টিলেটরের ফাঁকও । ৪. চোখ ধুয়ে নিতে হবে বারবার ।
পাঠকের মতামত: